দুর্গাপূজার বিবর্তনের ইতিহাস

বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতায় বারোয়ারি দুর্গাপূজার সূচনা ঘটে। অবশ্য কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরে বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজা অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
১৯১০ সালে ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট রোডে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে বারোয়ারি দুর্গাপূজা আয়োজিত হয়। এই পূজাটি আজও হয়ে আসছে।
এরপর ১৯১১ সালে শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীন, ১৯১৩ সনে শ্যামবাজারের শিকদারবাগান, ১৯১৯ সালে নেবুবাগান অর্থাৎ বর্তমান বাগবাজার সর্বজনীন এবং ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির বারোয়ারি দুর্গাপূজা শুরু হয়।
বারোয়ারি বলতে বোঝায় বাঙালিহিন্দুদের সর্বজনীন পূজা বা উৎসব।শব্দটি মূলত পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত।
“বারোয়ারি” শব্দটির উৎপত্তি সম্ভবত, বারো (১২) ও ইয়ার মানে বন্ধু শব্দদুটি থেকে। ১৭৯০ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় বারো জন ব্রাহ্মণ বন্ধু একটি সর্বজনীন পূজা করবেন বলে মনস্থ করেন। প্রতিবেশীদের থেকে চাঁদা তুলে আয়োজিত হয় সেই পূজা। এইভাবেই বাংলায় যে সর্বজনীন পূজানুষ্ঠানের সূচনা হয় তা লোকমুখে বারোয়ারি পূজা নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
প্রথম দিকে, দুর্গাপূজা কেবল কলকাতার ধনী বাবুদের গৃহেই আয়োজিত হত। কিন্তু বারোয়ারি পূজা চালু হওয়ার পর ব্যক্তি উদ্যোগে পূজার সংখ্যা হ্রাস পায় এবং দুর্গাপূজা একটি গণউৎসবে পরিণত হয়।
১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেব দুর্গাপূজা শুরু করেন। তার নির্দেশিত পথেই দুর্গাপূজা পরবর্তীকালে কলকাতার ধনিক বাবু সম্প্রদায়ের মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে।
শাস্ত্রাচার এই সব পূজায় গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যে পূজায় যত বেশি সংখ্যক আমন্ত্রিত ইংরেজ অতিথি উপস্থিত হতেন, সেই পূজার মর্যাদা ততই বাড়তো। বাইজি নাচের আসর বসত। ইংরেজরা এসে নাচগান করতেন, তাদের জন্য উইলসন হোটেল থেকে গোরু ও শূকরের মাংস আনানো হত এবং মদ্যপানের আসরও বসত।
রানি রাসমণিই প্রথম, এই প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে শুদ্ধাচারে তার জানবাজারের বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করেন।
ইংরেজ অতিথিদের চিত্তবিনোদনের বদলে, তার দেশীয় প্রজাদের বিনোদনের জন্য পূজা উপলক্ষে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ১৮৬১ সালে তার মৃত্যুর পর রানির জামাতাগণ নিজ বাসভবনে তার প্রদর্শিত পথেই, দুর্গাপূজার আয়োজন করতে থাকেন।
১৬১০ সাল থেকে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার বড়িশায় তাদের আদি বাসভবনে দুর্গাপূজার আয়োজন করে আসছেন। এটিই সম্ভবত কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গোৎসব। বর্তমানে এই পরিবারের সাত শরিকের বাড়িতে সাতটি দুর্গাপূজা হয়।
এগুলির মধ্যে ছয়টি বড়িশায় ও একটি বিরাটিতে। বড়িশার দুর্গাপূজাগুলি হল আটচালা, বড়ো বাড়ি, মেজো বাড়ি, বেনাকি বাড়ি, কালীকিংকর ভবন ও মাঝের বাড়ি।

ব্যাক্তির আঙিনা থেকে জনগণের হয়ে ওঠার, দুর্গাপূজার বিবর্তনের এই ইতিহাস, হালফিলের থিমের পুজোর প্রেক্ষাপটে, আজও সমান প্রাসঙ্গিক।

লেখক @ গৈরিক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *